public/icons8-arrow-back-96.pngসকল

ফারাক্কা বাঁধঃ বাংলাদেশের নীরব ব্যাথা

প্রতিনিধি শাকিল শাহরিয়ার, শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ.

শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪ এ ৮:৩৯ PM
https://i.ibb.co/bWTBN7n/main-qimg-d5a8c1ddb7b4321b4144c050e97013e8-lq.jpg
ফারাক্কা বাঁধ চাপাইনববগঞ্জ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদে বিপর্যয় নেমে এসেছে। দেশের দক্ষিণে ও পশ্চিমাঞ্চলে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের চার কোটিরও বেশি মানুষ।


১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফুট) লম্বা যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কিমি)।


১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে পলি জমা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই পলি ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গার ৪০,০০০ ঘনফুট জল হুগলি নদীর অভিমুখে চালিত করে।


হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বাঁধটি তৈরি করে। বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জল এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। এই বাঁধের উপর দিয়ে গিয়েছে ৩৪নং জাতীয় সড়ক ও রেলপথ। যা কেবল উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গকেই নয়, ভারতের উত্তরপূর্ব অংশকে বাকী ভারতের সঙ্গে জুড়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে। এই বাঁধের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল জলের অভাবে হারিয়ে যেতে বসা গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার জলে পুষ্ট করে, দিন দিন ন‍ব‍্যতা হারিয়ে যাওয়া কলকাতা বন্দরকে পূর্বারূপে কার্যক্ষম করে তোলা।


কলকাতা বন্দরকে পলির হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ভারত কর্তৃক প্রায় ১৮ মাইল উজানে মনোহরপুরের কাছে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশে বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক ও ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানির একতরফা প্রত্যাহার বাংলাদেশের কেবল প্রতিবেশ ও পরিবেশ ব্যবস্থাই ধ্বংস করছে না বরং এ দেশের কৃষি, শিল্প, বনসম্পদ ও নৌযোগাযোগের মতো অর্থনৈতিক খাতগুলির ওপরও হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।


১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে গঙ্গা প্রশ্নে জরুরি আন্তরিক আলোচনা শুরু করে। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (JRC)। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় এক যৌথ ঘোষণায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, ফারাক্কা প্রকল্প চালু করার আগে গঙ্গায় বছরে সর্বনিম্ন প্রবাহের সময়কালে নদীর জলবণ্টন প্রশ্নে তারা পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য একটি মতৈক্যে উপনীত হবেন। ঐ শীর্ষ বৈঠকে আরও স্থির হয় যে, শুষ্ক মৌসুমের পানি ভাগাভাগির পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে কোন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না।


১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে গঙ্গা প্রশ্নে জরুরি আন্তরিক আলোচনা শুরু করে। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (JRC)। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় এক যৌথ ঘোষণায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, ফারাক্কা প্রকল্প চালু করার আগে গঙ্গায় বছরে সর্বনিম্ন প্রবাহের সময়কালে নদীর জলবণ্টন প্রশ্নে তারা পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য একটি মতৈক্যে উপনীত হবেন। ঐ শীর্ষ বৈঠকে আরও স্থির হয় যে, শুষ্ক মৌসুমের পানি ভাগাভাগির পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে কোন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না।


বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে ভারতকে মাত্র ১০ দিনের (২১ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২১ মে ১৯৭৫) জন্য গঙ্গা নদীর ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু মুজিবুর রহমান হত্যার পর ভারত কোনোরকম আলোচনায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে।


১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী থেকে ১১৩০ কিউসেক পানি অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগরথি-হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে। ভারতকে পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে, বাংলাদেশ এই বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের সঙ্গে করা ভারতের এ ধরনের অন্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনা করা হলেও বিষয়টি ভারত খুব একটা পরোয়া করেনি।


২৬ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টি সুরাহার করার নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর কয়েকবার বৈঠকের পর উভয় দেশ ৫ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তী পাঁচ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে। ১৯৮২ এর অক্টোবরে উভয় দেশ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে পানি বণ্টনের একটি চুক্তি করে। নভেম্বর ১৯৮৫ সালে আরও তিন (১৯৮৬-৮৮) বছরের জন্য পানি বণ্টনের চুক্তি হয়। এই পানিবন্টন চুক্তির কোনোটি ঠিকমতো মানেনি ভারত।


এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা জরুরি যে বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ সংগঠিত করা। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যখন ফারাক্কা লং মার্চের নেতৃত্ব দেন তখন তার বয়স ৯০ বছরের বেশি।


উনিশশো ছিয়াত্তর সালের গোড়ার দিকে মাওলানা ভাসানী বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ছিয়াত্তরের ১৮ই এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাহলে তিনি লংমার্চ করবেন। তাঁর এই কর্মসূচি তখন অনেককে বেশ চমকে দিয়েছিল। কারণ ৯০ বছরের একজন মানুষের ঘরেই থাকার কথা। এ জন্য ১৬ই মে রাজশাহী শহর থেকে লংমার্চ করার ঘোষণা দেন তিনি। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ১৯৭৬ সালের ২ মে মাওলানা ভাসানীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফারাক্কা মিছিল'পরিচালনা জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়। এর পরে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।


এই লংমার্চের আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লিখেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সে চিঠিতে মিসেস গান্ধির কাছে লংমার্চের কারণ বর্ণনা করেন ভাসানী।


জাতীয় কৃষক সমিতির আবু নোমান খান সে লংমার্চ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন মজলুম জননেতা : মাওলানা ভাসানী স্মারক সংকলন’ বইতে। আবু নোমান খান লিখেছেন, লংমার্চের মিছিল রাজশাহী থেকে প্রেমতলী, প্রেমতলী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মনকষা এবং মনকষা থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত ৬৪ মাইল অতিক্রম করবে। মাওলানা ভাসানীর অনুসারীরা তাকে একজন রাজনীতিবিদের চেয়ে ‘দার্শনিক’ হিসেবেই বেশি বিবেচনা করতেন। তার সমর্থকরা মনে করেন, ৪৫ বছর আগে ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী যা অনুমান করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটিই ঘটেছে। বাংলাদেশের একজন লেখক আহমদ ছফাকে উদ্ধৃত করে ১৯৯৫ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটছে এটা তার চেয়ে স্পষ্ট করে কেউই বোঝে নাই।’ উনিশশো ছিয়াত্তর সালের ১৬ মে রাজশাহী শহর থেকে ফারাক্কা অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। হাজার-হাজার মানুষ সমবেত হয় সেই মিছিল ও জনসভায়।


১৯৮৯ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে।


১৯৯২ সালের মে মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর এক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ভারত বাংলাদেশকে সমান পরিমাণ পানি দেওয়ার ব্যাপারে সম্ভাব্য সব কিছু করবে। ফলে এরপর দুই দেশের মধ্যে কোনো মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়নি।


১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অঞ্চলে মাত্র ২৬১ কিউসেক পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়, যেখানে ফারাক্কা-পূর্ব সময়ে একই অঞ্চলে ১৯৮০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। ১৯৯৩ সালের মে মাসে যখন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আবার মিলিত হন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশেকে দেওয়া তার কথা রাখতে ব্যর্থ হন। একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি।


অবশেষে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হয়। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড় এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন।


ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। আর ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ৪০ হাজার কিউসেক পাবে ভারত, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ।


অথচ ভারতের খেয়ালখুশি মতো বাঁধ থেকে অনিয়ন্ত্রিভাবে পানি অপসারণ ও বন্ধের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানি সংকট ও বর্ষা মৌসুমে প্রবল বন্যার কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা চুক্তিতে পানি বন্টনের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা থাকলেও সেটি ঠিকমতো মানছে না ভারত। প্রতিটি চুক্তির পর ভারত অন্যায়ভাবে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে।


শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবং সৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে । ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নরূপ :


১.পদ্মা নদী দিয়ে পলি প্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।

২.কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%।

৩.পলি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।

৪. পদ্মা নদী দিয়ে পলি প্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%।


পলি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।


মিনারেল এবং নিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার ফলে নদী ও জলাভূমিতে ফাইটোপ্লাকটন উৎপাদন কমেছে ৩০%। ফাইটোপ্লাকটন হচ্ছে খাদ্য চক্রের প্রথম ধাপ। এ থেকে ক্রমান্বয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের উৎপাদন ঘটে। পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বল্লেই চলে। ইলিশ মাছ স্যাড গোত্রীয় মাছ। ০-৪২০ বিষ্ণুরেখার যেখানেই সমুদ্র সংলগ্ন নদী রয়েছে সেখানেই এই মাছ পাওয়া যায়। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ঐ ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সংবেদনশলীল। ফারাক্কার আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশঙ্কা করা হয় পদ্মা এবং তার কমান্ড অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।

৫. জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারী তলোয়ারের মত কাজ করছে। একদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। এর হার বছরে ৫ মি.মি.। নদীর প্লাবনের কারণে সঞ্চিত পলি সাবসিডেনসের নেতিবাচক প্রভাবকে এতকাল পুষিয়ে নিয়ে আসছিল। ফারাক্কার কারণে এমনটি আর হতে পারছে না ।


৬. টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোশিও ইসুজুকা ও আমাদের যৌথ গবেষণায় ষ্ট্রনসিয়াম আইসোটপ সমীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে সময় অনুচক্রে তীব্র ফাইটোপ্লাকটন বিকাশ ঘটে। আর এর অনুঘটক হচ্ছে নদী বাহিত নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি উপাদান ও মিনারেল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগর জুড়ে মৎস্য উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরের মাছের উপর ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠিও নির্ভরশীল।একই সাথে কার্বন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার উপশম কম হবে।


৭. প্রফেসর কেট ক্র্যান্ক (কানাডা) এর সাথে যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কণার সাইজ এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ।


পদ্মায় বর্তমানে শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। এর বিরূপ প্রভাবে দেশের দক্ষিণে ও পশ্চিমাঞ্চলে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের চার কোটিরও বেশি মানুষ। একে একে শুকিয়ে যাচ্ছে পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলো। অসংখ্য নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ৫৭টি নদীর মধ্যে ৫৪টির মূল উৎস তিব্বত, নেপাল, ভুটান ও ভারতের পর্বতময় অঞ্চল। যার ফলে পানির অবাধ প্রবাহে ফারাক্কার মতো বাঁধগুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এই বাঁধের প্রভাবে দেশের মানচিত্র থেকে প্রায় ৪৯টিরও বেশি নদ-নদী হারিয়ে গেছে এবং আরো প্রায় ১০০টি ছোট-বড় নদী একই পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।


এ দিকে শুকনো মৌসুমে নদীতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ও উচ্চতাও কমে যাচ্ছে। এ দেশের পাতাল পানিতে আর্সেনিক বিষের ঘনত্ব আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ফারাক্কা। স্রোত না থাকায় এ দেশের নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে এর উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নদীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় প্রতি বছর অত্যধিক হারে নদীভাঙনের ফলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে।


গঙ্গার এই বাঁধের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্যয় আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের সুন্দরবন, যা বিশ্ব হেরিটেজ নামে পরিচিত তা ধ্বংসের মুখে। পদ্মার একটি বড় শাখা নদী গড়াই কার্যত শুকিয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে খুলনার আশপাশে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ৫০০ মাইক্রোমোস ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের ফলে খুলনার লবণাক্ততা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ মাইক্রোমোস। এই লবণাক্ততা খুলনার ধারে ২৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত উজানে সম্প্রসারিত হয়েছে।


প্রকৃতির আপন গতিকে কৃত্রিমতা দ্বারা পরিবর্তন করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই। বর্তমানে এই ফারাক্কা বাঁধ ভারতের জন্যেও হুমকির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে। যে কলকাতা বন্দর টিকিয়ে রাখতে এই বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, বাঁধ নির্মাণের ৪৮ বছর পরেও কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো যায়নি। এমনকি কলকাতা বন্দরকে সচল রাখতে বর্তমানে যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয়-ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগেও এতটা ড্রেজিং দরকার হতো না। বাঁধ নির্মাণের আগে স্থানীয় অধিবাসীদের বলা হয়েছিল, ফারাক্কা চালু হলে আর বন্যা হবে না। কিন্তু অতীতের তুলনায় ভয়াবহ বন্যা দেখা গিয়েছে শুধু বাঁধের কারণে।


শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পার্শ্ববর্তী বিহারও ফারাক্কা বাঁধের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে গত বছর বন্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ও ২ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকারের দাবি, ফারাক্কা বাঁধের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং প্রায় প্রতিবছরই রাজ্য বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে। বছর বছর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থামাতে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার ফারাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।


প্রকৃতি যে কতবড় শক্তিশালি তার বাস্তুব উদাহরণ এই ফারাক্কা বাঁধ। গঙ্গার পানিপ্রবাহ পরিবর্তনের কারণে প্রতিবেশী দুটি দেশে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। তাই বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের জন্য অভিশাপস্বরূপ এই ফারাক্কা বাঁধ অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়াই হবে উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক।

Copyright © 2024

Daily Metro All rights reserved

Privacy Policy
fb.pngX.pnggmail.pngig.pngwhatsApp.png